জবাবদিহি না থাকলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যে দুঃশাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তার বহু জ্বলন্ত প্রমাণ আমাদের নিকট ইতিহাসে আছে। জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে রংপুরে পুলিশ কয়েক হাত দূর থেকে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নানা রকম সাফাই গাওয়ার চেষ্টা হয়। তাঁরা বলতে লাগলেন, আবু সাঈদ গুলিতে মারা যাননি। আবু সাঈদকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সরকার গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। যখন করেছে, তখন আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতা সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন।
এ রকম হত্যাকাণ্ড অভ্যুত্থানের সময়, তার আগে আরও অনেক ঘটেছে। বাংলাদেশের পুলিশ সম্পর্কে জনমনে ধারণা হয়েছিল, তারা অপরাধী ধরার চেয়ে সন্দেহভাজন মানুষকে গুলি করতে পারলেই বেশি খুশি হতো। ২০২০ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার ও তাঁর সহযোগীরা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহাকে মাদক পাচারকারী বানিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। ২০১৮ সালে টেকনাফের যুবলীগ নেতা একরামকে র্যাব হত্যা করে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে। সেই হত্যার ভিডিও ফাঁস হওয়ার পরও সরকার ব্যবস্থা নেয়নি।
র্যাব–পুলিশের হাতে এ রকম অসংখ্য নিরীহ মানুষ মারা গেছেন, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং যাঁরা বন্দুকযুদ্ধে বেশি মানুষ মেরেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব ও এর ছয় শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপরও সরকারের টনক নড়েনি। তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভুল তথ্যের ভিত্তিতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।’ জবাবদিহি না থাকলে একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রধান যে কত দুর্বিনীত হতে পারেন, তার প্রমাণ সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় তিনিও ছিলেন।
জুলাই–আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচার গুলি ও মানুষ হত্যার ঘটনায় শহীদ পরিবারগুলোর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইলেন পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের স্বার্থ রক্ষায়, তাদের নির্দেশে পুলিশের কতিপয় সদস্য বাড়াবাড়ি করেছেন এবং আইন ভঙ্গ করেছেন; এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অনেক নিরপরাধ পুলিশ সদস্যও নিহত হয়েছেন। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই নিন্দনীয়। আমি পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিটি শহীদ পরিবারের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
৯ ডিসেম্বর জুলাই আন্দোলনে অপেশাদার আচরণের জন্য ক্ষমা চান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
১২ ডিসেম্বর র্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমানও সংবাদ সম্মেলন করে অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান এবং আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘র্যাব সৃষ্টির পর থেকে যাঁরা র্যাব দ্বারা নির্যাতিত বা অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁদের কাছে এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ যাঁরা র্যাবের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের কাছে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
একই সঙ্গে এই কর্মকর্তা তাঁর দায়িত্ব চলাকালে র্যাব কখনো কারও নির্দেশে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ—গুম, খুন করবে না বলেও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন। এ কে এম শহিদুর রহমান ৮ আগস্ট র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন।
পুলিশ ও র্যাবের তিন শীর্ষ কর্মকর্তার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক মনে করেন গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং আন্দোলনে সক্রিয় শিক্ষক ও অধিকারকর্মীরা। তাঁদের দাবি, যাঁদের নির্দেশে ও যাঁদের গুলিতে নির্বিচার মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
উল্লেখ্য, গত চার মাসে ১৬ জন র্যাব সদস্যকে আটক করা হয়েছে। ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ছিনতাইয়ের অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়। অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুজন সাবেক আইজিপি কারাগারে বন্দী আছেন।
পুলিশ ও র্যাবের তিন শীর্ষ স্তরের কর্মকর্তা অতীতের হত্যা ও গুমের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এটি অবশ্যই ইতিবাচক ঘটনা। কিন্তু যে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে থেকে তাঁরা কাজ করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে কেউ ক্ষমা চাননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত চার মাসেও কোনো নেতা বা নেত্রী অনুশোচনা করেছেন, এমন নজির নেই। ২০০৪ সালে বিএনপি আমলে যখন র্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়, আওয়ামী লীগ তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসে র্যাব বাতিল না করে আরও শক্তিশালী করেছে। সে সময় কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে ‘প্রতিযোগিতা’ হতেও দেখেছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। ক্ষমতার বাইরে থেকে এখন যেসব কথা বলছেন, ক্ষমতায় গিয়ে সেটা কতটা রক্ষা করতে পারবেন, সেটাও দেখার বিষয়। মেজর হাফিজের ভাষায়, গ্যাংগ্রিনে শরীরের কোনো অংশ নষ্ট হয়ে গেলে সেটা কেটে দিতে হয়। র্যাব যদি গ্যাংগ্রিন হয়ে থাকে, তার সৃজন ও লালনকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনবে কে?