সোমবার   ডিসেম্বর ২৩ ২০২৪   ৯  পৌষ  ১৪৩১


আগরতলা মিশনে ভিসা সেবা বন্ধ করল বাংলাদেশ

MD. Sayem Uddin

Updated 24-Dec-04 /   |   স্টাফ রিপোর্টর   Read : 13
ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে জাতীয় নাগরিক কমিটির বিক্ষোভ। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়

ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন আক্রান্ত হওয়ার পর সেখানকার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নিরাপত্তাহীনতাজনিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সহকারী হাইকমিশনের সব ধরনের ভিসা ও কনস্যুলার সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকেরা গত সোমবার সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল। এ সময় তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল দুপুরে তলব করেছে। এ সময় আগরতলার ঘটনায় বাংলাদেশ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁর হাতে একটি প্রতিবাদপত্র তুলে দেয়।

আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশ। বদলি করা হয়েছে জ্যেষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। ভাঙচুরের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাতজনকে।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ভারতের অভিযোগ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে। এই পরিস্থিতিতে কয়েক দিন ধরে ভারতের কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা ও বিক্ষোভের মধ্যে সোমবার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে গতকালও বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। আর আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে গতকালও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিক্ষোভ হয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনসহ দেশটির বিভিন্ন মিশনের আশপাশে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ বলে আসছে, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতের হাইকমিশনারকে তলব

আগরতলার বাংলাদেশ মিশনে হামলার প্রতিবাদ জানাতে গতকাল দুপুরে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ তলব করেন। এ সময় ভারতীয় শীর্ষ কূটনীতিকের হাতে একটি প্রতিবাদপত্র তুলে দেওয়া হয়। অবশ্য সোমবার রাতে বাংলাদেশের ওই প্রতিবাদপত্র দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।

ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। গতকাল বিকেলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর সঙ্গে প্রণয় ভার্মার সাক্ষাতের ব্যাপ্তি ছিল ৩০ মিনিটের বেশি।

জানা গেছে, সোমবার রাতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছিল, সেটি হাইকমিশনারের হাতে দেওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে এটা জানানো হয়েছে যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক একটা রূপ আছে। আবার ত্রিপুরাসহ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ। তাই সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে আগরতলা, কলকাতা, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানের বাংলাদেশ মিশনগুলোকে ঘিরে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে যেন কার্যকরভাবে যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

ভারতীয় হাইকমিশনার এ সময় ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবকে জানিয়েছেন, আগরতলার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর বেশ কয়েকজনকে আটক, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মিশনকে ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। শুধু ত্রিপুরায় নয়, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানের বাংলাদেশ মিশনগুলোকে ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের কোনো হাইকমিশনারকে এই প্রথম মন্ত্রণালয়ে তলব করা হলো। এর আগে ২০১৯ সালে ঢাকায় তখনকার হাইকমিশনার রীভা দাশ গাঙ্গুলিকে তলব করেছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তখনকার মহাপরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ) আন্দালিব ইলিয়াস। তখন আসামের গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুরের গাড়িতে হামলার প্রতিবাদে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছিল। ওই সময় নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে আন্দোলন চলার সময় একদল বিক্ষোভকারী তানভীর মনসুরের গাড়িতে হামলা চালায়।

বহুমুখী সম্পর্ককে একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ করতে পারি না

তলব শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বের হওয়ার সময় প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বিস্তৃত ও বহুমুখী, এখানে কথা বলার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। এই সম্পর্ককে শুধু একটি মাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। আমরা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে দুই দেশের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজ করতে আগ্রহী।’

ভারতের হাইকমিশনার আরও বলেন, ‘আমরা সত্যিকার অর্থে একটি গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্ক চাই। এখানে অনেক বিষয় রয়েছে। অনেক বিষয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। পরস্পরের ওপর এই নির্ভরশীলতাকে আমরা উভয়ের স্বার্থে কাজে লাগাতে চাই। আমরা আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখব, যাতে আমাদের দুই দেশই উপকৃত হয়। এখানে অনেক ইতিবাচক অগ্রগতিও রয়েছে।’

আগরতলায় বন্ধ কনস্যুলার সেবা

ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের পাশাপাশি কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, গুয়াহাটি ও আগরতলায় উপহাইকমিশন/সহকারী হাইকমিশন রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন ভিসাসহ নানা রকম কনস্যুলার সেবা দিয়ে থাকে। কনস্যুলার সেবার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকদের কারও প্রয়োজন হলে ভ্রমণের অনুমতি-সংক্রান্ত পাস দেওয়া, আইনি সহায়তা দেওয়া।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারতের নাগরিকদের জন্য ওই মিশন থেকে প্রতিদিন আড়াই শ-তিন শ ভিসা ইস্যু করা হতো।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার কারণে আপাতত আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে কনস্যুলার সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে ওই মিশন থেকে বাংলাদেশের ভিসা সেবা বন্ধ থাকবে।

সোমবার আগরতলার বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা এবং মুম্বাইয়ের উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভের পর গতকালও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, গতকাল উত্তর প্রদেশের আলীগড়, অযোধ্যা, বানদাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ত্রিপুরার আগরতলায় ‘সনাতনী যুব’ ব্যানারে বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের আখাউড়া চেকপোস্টের দিকে এগোতে চাইলে তাঁদের বাধা দেয় ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা গতকাল দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ ফাঁড়ির সামনে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করেন। এতে নেতৃত্ব দেন দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস নেতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় ও প্রদীপ প্রসাদ।

এদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) আজ বুধবার কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের কাছে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের এক কূটনীতিক গতকাল সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদককে জানান, বিক্ষোভটি যাতে বাংলাদেশ উপহাইকমিশন থেকে বেশ কিছুটা দূরে থামিয়ে দেওয়া হয়, সে বিষয়ে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে মিশনের আশপাশে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।